বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যাবস্থার প্রেক্ষাপটে মেরিন ডিপ্লোমাধারীদের মেরিন ক্যাডেট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত কি না— সেটি নির্ভর করছে দেশের সামুদ্রিক খাতের ভবিষ্যৎ, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং পেশাগত মান রক্ষার উপর।
প্রথমেই জানতে হবে, মেরিন ক্যাডেট ও মেরিন ডিপ্লোমা কোর্সের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী। মেরিন ক্যাডেট হচ্ছে এমন একটি পেশাদার প্রশিক্ষণধারী, যারা মূলত আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থা (IMO)-এর নির্ধারিত STCW কোর্সের অধীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং যারা নির্দিষ্ট সময় সমুদ্রে ‘সি টাইম’ সম্পন্ন করে অফিসার হওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। তাদের প্রশিক্ষণ কাঠামো, কোর্স কনটেন্ট, শৃঙ্খলা, মেডিকেল মান এবং আন্তর্জাতিক আইন সংক্রান্ত জ্ঞান এমনভাবে সাজানো হয়, যেন তারা ভবিষ্যতে মাস্টার মেরিনার বা চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জাহাজ পরিচালনায় দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন।
অন্যদিকে, মেরিন ডিপ্লোমা একটি সাধারণ কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রম, যা মূলত ইনস্টিটিউশনভিত্তিক এবং দেশের কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন। এটি আন্তর্জাতিক IMO স্ট্যান্ডার্ডে স্বীকৃত নয়, বরং জাতীয় পর্যায়ের একটি কারিগরি কোর্স, যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রাথমিক কিছু ধারণা লাভ করেন। যদিও এটিও একটি সম্মানজনক কারিগরি শিক্ষাক্রম, তবে এর কাঠামো, গভীরতা ও বাস্তব প্রশিক্ষণ মেরিন ক্যাডেট প্রোগ্রামের তুলনায় অনেকটাই সীমিত।
এই দুটি পৃথক শিক্ষাক্রম ও প্রশিক্ষণ কাঠামোকে এক করে দেওয়ার দাবি শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ফেলতে পারে। আন্তর্জাতিক শিপিং ইন্ডাস্ট্রি যেভাবে যোগ্যতা যাচাই করে, তাতে করে মেরিন ডিপ্লোমাধারী যদি মেরিন ক্যাডেট হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তাহলে বাংলাদেশের জাহাজ পরিচালনা, নিরাপত্তা মান এবং নিয়োগপ্রাপ্তির হার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আরেকটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে—যদি মেরিন ডিপ্লোমাধারীকে মেরিন ক্যাডেট হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলে বাংলাদেশে প্রচলিত প্রফেশনাল ট্রেনিং কাঠামো কীভাবে মান বজায় রাখবে? বর্তমানে নটিক্যাল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ক্যাডেট হিসেবে যাঁরা ভর্তি হন, তাদের বাছাই হয় আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মেডিকেল চেকআপ, ইংরেজি দক্ষতা, ফিজিক্যাল ফিটনেস এবং একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাইয়ের মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে ডিপ্লোমাধারীদের সেই মান অনুযায়ী যাচাই না করে যদি সরাসরি ক্যাডেটের মর্যাদা দেওয়া হয়, তাহলে পুরো সিস্টেমটির গ্রহণযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
এছাড়া, মেরিন ক্যাডেটদের জন্য যে ‘সি টাইম’ বা সমুদ্রে প্রশিক্ষণের বাধ্যবাধকতা আছে, তা মেরিন ডিপ্লোমাধারীদের প্রশিক্ষণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে না। ‘সি টাইম’ শুধুমাত্র একটি সময়কাল নয়, এটি হচ্ছে একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের সময়, যেখানে ক্যাডেটরা জাহাজ চালনা, যন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা, আন্তর্জাতিক মেরিটাইম আইন মেনে চলা এবং নানা ধরনের শিপবোর্ড অপারেশন শেখে। ডিপ্লোমাধারীদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক নয় বলে তাদের হাতে-কলমে অভিজ্ঞতার ঘাটতি থেকেই যায়। এই ঘাটতি পূরণ না করে যদি তাদের ক্যাডেটের সমমর্যাদা দেওয়া হয়, তাহলে এর ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ।
আরেকটি দিক হলো আন্তর্জাতিক নিয়োগদাতাদের দৃষ্টিভঙ্গি। বর্তমানে ফিলিপাইন, ভারত, ইউক্রেন, চীন, গ্রিসসহ অনেক দেশ থেকে মেরিন ক্যাডেটরা আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিতে কাজ করছে। এসব নিয়োগদাতা প্রত্যাশা করে, একজন ক্যাডেট যেন IMO নির্ধারিত প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে, স্ট্যান্ডার্ড কোর্স ফলো করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সার্টিফিকেটধারী হন। যদি বাংলাদেশ এ স্ট্যান্ডার্ড থেকে বিচ্যুত হয়ে ডিপ্লোমাধারীদের ক্যাডেট হিসেবে পাঠাতে শুরু করে, তাহলে আন্তর্জাতিক নিয়োগদাতারা বাংলাদেশের প্রশিক্ষণ কাঠামো নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়বে এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগে অনাগ্রহী হবে। এর ফলে যারা প্রকৃত ক্যাডেট হিসেবে কঠোর পরিশ্রম ও প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে, তাদেরও কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে।
এ ছাড়া, মেরিন ক্যাডেট ও মেরিন ডিপ্লোমার মধ্যকার এই ভিন্নতা শুধু জ্ঞান বা দক্ষতার স্তরে নয়, বরং এটি একটি পেশাগত পরিচিতির বিষয়। একজন মেরিন ক্যাডেটের পরিচয়, দায়িত্ব, ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র এবং র্যাংকিং—সবকিছুই সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত। একজন ক্যাডেট ধাপে ধাপে জাহাজের অফিসার হবেন, মাস্টার হবেন, পোর্ট ইন্সপেক্টর হবেন, কিংবা প্রশিক্ষক হবেন। কিন্তু মেরিন ডিপ্লোমা কোর্স মূলত কারিগরি সহকারী বা রেটিং পর্যায়ের কাজের জন্য প্রস্তুতি দেয়, যেমন জাহাজে ফিটার, ওয়েল্ডার বা টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করা। এই দুই ভিন্ন পেশাগত ধারা এক করে দিলে ভবিষ্যতে পেশাগত অস্পষ্টতা এবং সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দেবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে কয়েকটি মেরিটাইম একাডেমি রয়েছে, সেখানে মেরিন ক্যাডেটদের জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো, অফিসার ইনস্ট্রাকশন, লাইসেন্সিং, কোর্স মডিউল এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফিলিয়েশন গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে ডিপ্লোমা কোর্সগুলো পরিচালিত হয় মূলত টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজে, যাদের অবকাঠামো বা স্টাফিং মেরিটাইম প্রফেশন অনুযায়ী ডিজাইন করা হয়নি। সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে যদি মেরিন ডিপ্লোমা আর ক্যাডেটদের এক করে ফেলা হয়, তাহলে এটি হবে একটি বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত, যা পুরো নটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশের মেরিন ডিপ্লোমাধারীরাও একটি সম্মানজনক কারিগরি শিক্ষাক্রম শেষ করেন। তাদের জন্যও আলাদা কর্মক্ষেত্র, প্রশিক্ষণ এবং রেটিং-ভিত্তিক উন্নয়নপথ থাকা উচিত। সরকার চাইলে তাদের জন্য ‘Apprentice Seafarer’ বা ‘Technical Seafarer’ নামে একটি পৃথক মর্যাদা নির্ধারণ করতে পারে, যাতে তারা ধাপে ধাপে যোগ্যতা অর্জন করে অফিসার হওয়ার সুযোগ পায়। তবে এটি কখনোই সরাসরি ক্যাডেটের মর্যাদা পাওয়ার সমান নয়।
অতএব, বাংলাদেশে মেরিন ডিপ্লোমাধারীদের মেরিন ক্যাডেট হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান একদমই যুক্তিযুক্ত নয়। এটি পেশাগত মানহানির শামিল হবে, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস করবে এবং প্রকৃত ক্যাডেটদের জন্য বড় ধরণের অবিচার হবে। একে অপরের পেশাগত অবস্থানকে সম্মান জানানো এবং নিজ নিজ অবস্থানে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়াই হচ্ছে টেকসই সমাধান। ক্যাডেট হতে হলে ক্যাডেটের পথেই হাঁটতে হবে—আলাদা প্রশিক্ষণ, আলাদা লক্ষ্য এবং আলাদা দায়বদ্ধতার সঙ্গে। জাতীয় স্বার্থেই এই বিষয়টিকে স্পষ্ট এবং সুসংহত রাখা জরুরি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : নিজস্ব প্রতিবেদক